আমসত্ত্ব: ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি খাবার ও এর প্রস্তুত প্রণালী
আমসত্ত্ব বাংলা খাবারের ঐতিহ্যবাহী একটি মিষ্টি পদ। পাকা আমের রসে তৈরি এই খাবারটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র বাঙালি সমাজে বেশ জনপ্রিয়। এটি একদিকে মিষ্টি, অন্যদিকে পুষ্টিকর, এবং সংরক্ষণযোগ্যতার জন্যও বিশেষ পরিচিত। আমসত্ত্ব সাধারণত গ্রীষ্মকালে পাকা আমের মৌসুমে তৈরি হয় এবং সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়।
![]() |
আমসত্ত্ব |
আমসত্ত্ব: একটি পরিচিতি
আমসত্ত্ব শব্দটি এসেছে ‘আম’ এবং ‘সত্ত্ব’ শব্দ দুটির সংমিশ্রণে। এখানে ‘সত্ত্ব’ মানে হলো নির্যাস বা নির্যাসিত রস। আমসত্ত্ব হলো পাকা আম থেকে প্রস্তুত করা এমন একটি খাবার যা প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জীবনে সুস্বাদু মিষ্টি হিসেবে স্থান পেয়েছে। এটি শুধু একটি খাবার নয়; বরং বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি ও স্মৃতির একটি অংশ।
আমসত্ত্ব খেতে মিষ্টি, নরম ও চ্যাপ্টা ধরনের হয়। এর রঙ সাধারণত গাঢ় হলুদ থেকে লালচে বাদামী হয়ে থাকে। এটি একাধারে ছোটদের এবং বড়দের প্রিয় খাবার। পিকনিক, ভ্রমণ, অথবা স্বাভাবিক সময়ে মুখরোচক মিষ্টি হিসেবে আমসত্ত্ব বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
আমসত্ত্ব তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ
আমসত্ত্ব তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ খুবই সাধারণ, যা সাধারণত যে কোনো গৃহস্থালির রান্নাঘরেই থাকে। প্রধান উপকরণগুলো হলো:
- পাকা আম: আমসত্ত্ব তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভালো মানের পাকা আম। আম যত বেশি মিষ্টি হবে, আমসত্ত্ব ততই সুস্বাদু হবে।
- চিনি: স্বাদ অনুযায়ী চিনি ব্যবহার করা হয়। মিষ্টি আমের ক্ষেত্রে চিনির প্রয়োজন কম হয়।
- লেবুর রস: লেবুর রস যোগ করা হয় সতেজতা বজায় রাখতে এবং সংরক্ষণের সময় যাতে মিশ্রণটি নষ্ট না হয়।
আমসত্ত্ব তৈরির প্রক্রিয়া
আমসত্ত্ব বানানো একটি সহজ প্রক্রিয়া হলেও এতে ধৈর্য এবং সময় লাগে। নিচে ধাপে ধাপে আমসত্ত্ব তৈরির প্রক্রিয়া তুলে ধরা হলো:
১. আমের রস সংগ্রহ করা
পাকা আমগুলো ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে কেটে নিন। এরপর আমের শাঁস থেকে রস বের করুন। রসটি মসৃণ করতে ব্লেন্ডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে রসের মধ্যে কোনো আঁশ বা আঁটি থাকবে না।
২. রস ছেঁকা
আমের রস ব্লেন্ড করার পর তা ভালোভাবে ছেঁকে নিতে হবে। ছেঁকে নেওয়ার ফলে রসটি আরও মসৃণ হবে এবং আমসত্ত্বের টেক্সচার উন্নত হবে।
৩. মিশ্রণ প্রস্তুত
আমের রস একটি গভীর পাত্রে নিয়ে তাতে চিনি যোগ করুন। মিষ্টি আমের ক্ষেত্রে চিনির পরিমাণ কম এবং টক আমের ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে। এরপর এতে লেবুর রস মেশান। লেবুর রস খাবারটিকে সতেজ রাখে এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণে সাহায্য করে।
৪. রস ঘন করা
একটি নন-স্টিক কড়াই বা সসপ্যানে এই মিশ্রণটি ঢেলে মাঝারি আঁচে রান্না করুন। রান্নার সময় মিশ্রণটি ক্রমাগত নাড়তে হবে যাতে এটি পাত্রে লেগে না যায়। এটি ধীরে ধীরে ঘন হয়ে এলে এবং পাত্রের গা থেকে ছাড়তে শুরু করলে বুঝতে হবে যে এটি প্রস্তুত।
৫. শুকানোর প্রক্রিয়া
একটি চ্যাপ্টা পাত্র বা ট্রেতে ঘি বা তেল দিয়ে হালকা মসৃণ করে নিন। এরপর ঘন রসটি পাত্রে ঢেলে সমানভাবে ছড়িয়ে দিন। এই স্তরটি খুব বেশি পুরু বা খুব বেশি পাতলা হওয়া উচিত নয়। পুরু হলে শুকাতে সময় বেশি লাগবে, আর বেশি পাতলা হলে সহজে ফাটতে পারে।
৬. রোদে শুকানো
আমসত্ত্ব সাধারণত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে রোদে শুকানো হয়। এটি রোদে রাখার সময় মশা বা ধুলো থেকে বাঁচাতে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। শুকানোর জন্য ২-৩ দিন সময় লাগতে পারে।
৭. শুকানো শেষে কাটিং
আমসত্ত্ব পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে এটি পাত্র থেকে আলতো করে তুলুন। এরপর নিজের পছন্দমতো আকারে কাটুন। সাধারণত আয়তাকার বা চৌকো আকারে কাটা হয়।
![]() |
আমসত্ত্ব |
আমসত্ত্ব সংরক্ষণের উপায়
আমসত্ত্ব দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য। এটি শুকানোর পর বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করলে মাসের পর মাস ভালো থাকে। সংরক্ষণের সময় আমসত্ত্ব যাতে আর্দ্রতা না পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ভালোভাবে প্যাকেট করলে এটি ফ্রিজেও সংরক্ষণ করা যায়।
আমসত্ত্বের পুষ্টিগুণ
আমসত্ত্ব খেতে সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। পাকা আমে ভিটামিন এ, সি এবং আঁশ প্রচুর পরিমাণে থাকে। চিনির কারণে এটি দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। তবে যেহেতু এতে চিনি যোগ করা হয়, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
আমসত্ত্ব: সংস্কৃতি ও স্মৃতির অংশ
আমসত্ত্ব শুধু একটি মিষ্টি খাবার নয়; এটি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। গ্রীষ্মকালের ছুটিতে গ্রামাঞ্চলে আমসত্ত্ব তৈরি একটি পারিবারিক আনন্দের বিষয়। বাড়ির নারীরা একত্র হয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করেন এবং এটি দীর্ঘ সময় ধরে পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করেন।
উপসংহার
আমসত্ত্ব শুধু একটি মিষ্টি খাবার নয়, বরং বাঙালির ঐতিহ্যের একটি অমূল্য অংশ। এটি সহজলভ্য উপকরণে তৈরি হলেও এর স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ অতুলনীয়। যারা এখনও এই মিষ্টি স্বাদের খাবারটি তৈরি করেননি, তারা ঘরে বসেই এটি বানানোর চেষ্টা করতে পারেন। এটি আপনার পরিবারে আনন্দের একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।